বাংলাদেশের রাজনীতি ও বাংলাদেশের নির্বাচনের ভবিষ্যৎ

 



ভূমিকা

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র, যার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক, সমঅধিকারভিত্তিক ও জনগণের সার্বভৌমত্বে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র গঠন। বাংলাদেশের সংবিধান জনগণকে রাষ্ট্রের মালিকানার স্বীকৃতি দিলেও, স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিভিন্ন উত্থান-পতনের মুখোমুখি হয়েছে। রাজনীতি হয়ে উঠেছে সংঘাতমুখর, দলীয়করণ প্রবণ এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্বাচনী ব্যবস্থাকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমেই ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর ঘটে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা স্থিতিশীল হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নির্বাচনকে ঘিরে প্রশ্ন, বিতর্ক ও সংঘাত দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যমান। ফলে দেশের রাজনীতি এবং নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রায়শই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।

এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য, নির্বাচনী ব্যবস্থার বিবর্তন, বর্তমান চ্যালেঞ্জ, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হবে।


বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।

১. দ্বিমেরুতা বা দুই মেরুর রাজনীতি

বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়ে থাকে। স্বাধীনতার পর প্রথমে আওয়ামী লীগ, পরে সামরিক শাসনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দলসমূহ, বিশেষ করে বিএনপি—রাজনৈতিক অঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার করে। বর্তমানে দেশের রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষমতায় থাকা দল ও বিরোধী দলের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব।

২. সংঘাতমুখর রাজনৈতিক সংস্কৃতি

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ ও সংঘাত অস্বাভাবিক মাত্রায় প্রবল। সংসদ বর্জন, অবরোধ, হরতাল, সহিংসতা ইত্যাদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। ক্ষমতায় থাকা দল প্রশাসনকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে, আর বিরোধী দল ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে।

৩. ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব

রাজনীতিতে আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু পরিবারকেন্দ্রিক, বিএনপি জিয়া পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির প্রতীক। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা দুর্বল হয়েছে।

৪. উন্নয়ন বনাম গণতন্ত্র বিতর্ক

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণ ও ডিজিটাল অগ্রগতি হয়েছে। তবে একইসাথে গণতন্ত্রের পরিধি সংকুচিত হওয়া, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সমালোচনা রয়েছে।




বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার ইতিহাস ও বিবর্তন

১. স্বাধীনতার পর প্রাথমিক পর্যায় (১৯৭১–১৯৯০)

স্বাধীনতার পর প্রথম সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালে। তবে এর পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, সেনাশাসন ও স্বৈরাচারী শাসনের কারণে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা দুর্বল হয়। ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা, পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসন এবং বিতর্কিত নির্বাচন গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করে।

২. গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা (১৯৯১–২০০৮)

১৯৯০ সালের গণআন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচার পতনের পর গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। এ ব্যবস্থার অধীনে কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন তুলনামূলকভাবে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হয়। ফলে জনগণের আস্থা কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়।

৩. তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিলুপ্তি ও বর্তমান ব্যবস্থা (২০০৮–বর্তমান)

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর ক্ষমতায় আসে। ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এর ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রধান বিরোধী দলগুলোর বর্জনের কারণে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনও অনিয়ম, কারচুপি ও বিরোধী দলের সীমিত অংশগ্রহণের কারণে সমালোচিত হয়েছে।


বর্তমান চ্যালেঞ্জসমূহ

বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সামনে কয়েকটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

  1. নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা: কমিশনকে ক্ষমতাসীনদের প্রভাবমুক্ত রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

  2. প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাজনৈতিক ব্যবহার: নির্বাচনের সময় এসব সংস্থা অনেক সময় ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষায় অভিযুক্ত হয়।

  3. অসহিষ্ণু রাজনৈতিক সংস্কৃতি: সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপের সংস্কৃতি দুর্বল।

  4. ভোটারদের আস্থাহীনতা: পুনঃপুন বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে ভোটাররা ধীরে ধীরে আস্থা হারাচ্ছে।

  5. প্রযুক্তির প্রতি অনাস্থা: ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে।


নির্বাচনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

১. স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পুনর্গঠন

গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন ছাড়া এটি সম্ভব নয়।

২. প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার

ইভিএম বা অন্যান্য প্রযুক্তি নির্বাচনে ব্যবহৃত হলে আস্থা তৈরি করা অপরিহার্য। সঠিক প্রয়োগ হলে ভোটগ্রহণ দ্রুত ও স্বচ্ছ হতে পারে।

৩. তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা

বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ। তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সক্রিয়তা এবং পরিবর্তনের দাবি ভবিষ্যতের রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে।

৪. রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন

সংলাপ, আপস এবং সহযোগিতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা না হলে নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরে আসবে না। ভবিষ্যতে দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচন পরিচালনা অপরিহার্য।


আন্তর্জাতিক প্রভাব

বাংলাদেশের নির্বাচনের ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

  • আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা: দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনের ওপর গভীর নজর রাখে।

  • মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রশ্ন: জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নিয়মিত উদ্বেগ প্রকাশ করে।

  • অর্থনৈতিক সম্পর্ক: বিদেশি বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহযোগিতা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল। ফলে আন্তর্জাতিক চাপ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে।


সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন ব্যবস্থা একদিকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির দাবি করছে, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্প ও অবকাঠামো বৃদ্ধি দৃশ্যমান হলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন অনুপস্থিত। ফলে একদিকে রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে এগোচ্ছে, অন্যদিকে গণতন্ত্রের ভিত দুর্বল হচ্ছে।


উপসংহার

বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে সংঘাতমুখর এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা নড়বড়ে। তবে ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার নয়। তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা এবং আন্তর্জাতিক চাপ—সব মিলিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করার সম্ভাবনা রয়েছে।

গণতন্ত্র কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়ে পরিমাপ করা যায় না; এটি জনগণের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর নির্ভরশীল। তাই বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ এবং জনগণের আস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ওপর।

Post a Comment

0 Comments