গ্রীষ্মের সেই বিকেলটা ছিল একেবারেই ভিন্ন। বাতাসে লবণাক্ত গন্ধ, দূরে সমুদ্রের গর্জন আর আকাশজোড়া সোনালি আলো যেন আগাম ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে কিছু অলৌকিক ঘটতে চলেছে। ঠিক তখনই আরিয়ান আর মীরা প্রথম একে অপরকে দেখল। দু’জনেই ছিল তরুণ, স্বপ্নে ভরা, আর সীমাবদ্ধ জীবন থেকে অনেক দূরে ছুটে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় পাগল।
আরিয়ান ছিল অস্থির স্বভাবের ছেলে। পাহাড়-নদী, অচেনা পথ, অজানা শহর—সবকিছুই তাকে ডাকত। সে মনে করত জীবন মানেই খুঁজে চলা, থেমে না থাকা। অন্যদিকে মীরা ছিল চুপচাপ, স্বপ্নবাজ এক মেয়ে। সে আঁকতে ভালোবাসত, প্রতিটি সূর্যাস্তকে নিজের ক্যানভাসে ধরে রাখতে চাইত। কিন্তু মনের গভীরে তারও ইচ্ছে ছিল, শুধু রঙে নয়, জীবনের বাস্তব মুহূর্তগুলোতেও পৃথিবীর সৌন্দর্য ছুঁয়ে দেখার।
তাদের দেখা হয় সমুদ্রের ধারে এক স্থানীয় উৎসবে। চারদিকে রঙিন আলো, মানুষের কোলাহল, আর ছোট ছোট কাগজের ফানুস ভেসে উঠছিল আকাশে। সেখানেই হঠাৎ কথা হয় তাদের। আরিয়ান মীরাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি কি মনে করো দিগন্তের ওপারে সত্যিই নতুন কোনো পৃথিবী আছে?” মীরা প্রথমে অবাক হলেও হেসে বলেছিল, “হয়তো আছে, তবে হয়তো সেটা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।” এভাবেই শুরু হয়েছিল এক যাত্রার গল্প—দুই তরুণ হৃদয়ের সাহসী অঙ্গীকার।
পরের দিনগুলোতে তারা প্রায় প্রতিদিনই দেখা করত। কথা হতো ভবিষ্যৎ নিয়ে, ভ্রমণ নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে। একদিন তারা হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিল—সবকিছু পিছনে ফেলে তারা বেরিয়ে পড়বে। কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই, শুধু পথ আর পথের ভেতরে লুকানো গল্প।
তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ভাঙাচোরা ট্রেনে চেপে, যেখানে জানালার ধারে বসে তারা সবুজ মাঠ আর ছোট ছোট নদীকে দেখেছিল একেবারে নতুন চোখে। পথে পথে অচেনা মানুষের হাসি, গ্রামীণ খাবারের স্বাদ, পাহাড়ি ঝর্ণার ঠান্ডা জল—সবই হয়ে উঠেছিল তাদের ভালোবাসার সাক্ষী। অনেক কষ্টও ছিল। কখনো রাত্রি কাটাতে হয়েছে খোলা আকাশের নিচে, কখনো ক্ষুধা মেটাতে হয়েছে শুধু শুকনো রুটি খেয়ে। তবুও প্রতিটি কষ্টই তাদের একে অপরের আরও কাছাকাছি এনেছিল।
একদিন তারা শুনল এক কিংবদন্তির কথা—“ফিসফিসে পাহাড়ের”। বলা হয়, যে প্রেমিক-প্রেমিকা একসাথে সেই পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছতে পারবে, তারা বাতাসের ফিসফিসে তাদের ভবিষ্যৎ শুনতে পাবে। এই গল্প তাদের মনে আগুন ধরাল। তারা যাত্রা শুরু করল পাহাড়ের দিকে।
চড়াইটা ছিল ভয়ঙ্কর কঠিন। কাঁটা, পাথর, আর ঠান্ডা বাতাস তাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে ভারী করে তুলছিল। কিন্তু মীরা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল, আরিয়ান তার হাত ধরে বলেছিল, “আমরা পারব, শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থেকো।” আবার যখন আরিয়ানের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছিল, মীরা ফিসফিস করে বলেছিল, “তুমি একা নও, আমি আছি।” তাদের ভালোবাসা সেই চড়াইপথেই আরও দৃঢ় হয়ে উঠল।
শেষমেশ তারা পৌঁছল চূড়ায়। সামনে ছিল মেঘে ঢাকা অসীম দিগন্ত, আর সূর্যাস্তের আলো যেন স্বর্গ নামিয়ে এনেছিল পৃথিবীতে। হঠাৎ বাতাস বয়ে গেল, আর মীরার মনে হলো সে একটি ফিসফিস শুনতে পাচ্ছে—“যে ভালোবাসা দিগন্ত ছুঁতে চায়, তা কখনো নিভে না।” চোখে জল চলে এলো তার। আরিয়ানও শুনেছিল সেই আওয়াজ। সে মীরার চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে বলল, “মীরা, আমি ভেবেছিলাম আমি পৃথিবী খুঁজছি। কিন্তু আসলে আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম।”
মীরা কেঁদে হেসে বলল, “আমি ভেবেছিলাম আমি রঙ খুঁজছি। কিন্তু সব রঙ তো তোমার ভেতরেই আছে।” তারপর তারা একে অপরকে চুম্বন করল, আর সেই মুহূর্তটা পাহাড়, বাতাস, আর আকাশকে সাক্ষী করে অমর হয়ে গেল।
এরপরও তারা যাত্রা চালিয়ে গেল। তারা মরুভূমিতে নেচেছিল, সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে লড়াই করেছিল, অচেনা শহরে ছাদে দাঁড়িয়ে হাজারো আলো দেখেছিল। ভালোবাসা মানে শুধু রোমাঞ্চ নয়, এটা তারা শিখেছিল কষ্টের মুহূর্তে। যখন আরিয়ান অসুস্থ হয়ে পড়েছিল এক দূর শহরে, মীরা সারারাত তার পাশে বসেছিল। আরিয়ান চোখ খুলে যখন বলেছিল, “তুমি না থাকলে আমি পারতাম না,” তখন মীরা বুঝেছিল সত্যিকারের ভালোবাসা মানেই একসাথে বেঁচে থাকার সাহস।
এক সন্ধ্যায়, সমুদ্রতীরের বাতিঘরের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আরিয়ান মীরার হাতে একটি ছোট আংটি দিল। তার কণ্ঠ কেঁপে উঠছিল, “আমরা দিগন্ত পেরিয়েছি, পাহাড় জয় করেছি, ঝড় সামলেছি। কিন্তু সবচেয়ে বড় অভিযান এখনো বাকি। মীরা, তুমি কি সারাজীবন আমার সাথে থাকবে?”
মীরার চোখ ভিজে উঠল। সে কাঁপা কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ, হাজারবার হ্যাঁ।” তাদের আলিঙ্গনে তখন সমুদ্রের ঢেউ আর তারাভরা আকাশও যেন গাইতে শুরু করেছিল।
তাদের ভালোবাসার গল্প শেষ হয়নি, আর হয়ও না। পৃথিবীর পথে পথে যে ভ্রমণকারীরা তাদের সঙ্গে দেখা করেছিল, তারা প্রায়ই গল্প করত—দুই তরুণ হৃদয়ের কথা, যারা সীমাহীন দিগন্তে পা রেখেছিল এবং খুঁজে পেয়েছিল এমন এক ভালোবাসা, যা সময়কেও হার মানায়।
কারণ আসল ভালোবাসা শুধু গন্তব্যে নয়, প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি সাহসে, প্রতিটি প্রতিশ্রুতিতে। আর আরিয়ান আর মীরার গল্প চিরকাল বেঁচে থাকবে আকাশের তারাদের মতো, যারা প্রতিটি তরুণ হৃদয়কে ফিসফিস করে বলবে—“দিগন্তের ওপারে যেও, ভালোবাসা তোমার পথ দেখাবে।”
No comments:
Post a Comment