Friday, May 9, 2025

ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়

 



“ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়”—এই বাক্যটি শুধু একটি উক্তি নয়, এটি একটি আদর্শ, একটি নৈতিক মূল্যবোধ, যা একটি সুশৃঙ্খল, উন্নত ও দেশপ্রেমিক সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য। সমাজ গঠনে ব্যক্তি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো দল বা গোষ্ঠী। কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে থাকে একটি জাতি বা রাষ্ট্র। এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব কেন ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, এবং দলের চেয়ে দেশ সবচেয়ে বড়। আমরা দেখব এ আদর্শ সমাজ, রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষাঙ্গন এবং প্রতিদিনের জীবনে কতটা প্রাসঙ্গিক।


ব্যক্তি, দল ও দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক

প্রতিটি দেশ গঠিত হয় অসংখ্য ব্যক্তি ও দলের সম্মিলনে। ব্যক্তি হল রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম একক। ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ, কর্মকাণ্ড সমাজে প্রভাব ফেলে। কিন্তু ব্যক্তির শক্তি সীমিত; একা একজন ব্যক্তি কখনও সমাজে বৃহৎ পরিবর্তন আনতে পারে না, যতক্ষণ না সে দলবদ্ধ হয়। একটি দল—হোক সেটা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক কিংবা পেশাজীবী—যখন কোনো বৃহৎ লক্ষ্যে একত্রিত হয়, তখন তার প্রভাব বহুগুণে বেড়ে যায়। আর এই দলগুলোই শেষ পর্যন্ত জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অবদান রাখে।

একটি রাষ্ট্র তখনই শক্তিশালী হয়, যখন ব্যক্তি নিজের স্বার্থের চেয়ে দলের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় এবং দল দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চে স্থান দেয়। তখনই গড়ে ওঠে একটি আত্মবিনিয়োগকারী, দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক জাতি।


ব্যক্তির চেয়ে দল বড়—এর তাৎপর্য

যখন একজন ব্যক্তি দলের অংশ হয়, তখন সে একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্যের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করে। এই বৃহত্তর উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত চাহিদার সীমা ছাড়িয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক যদি শুধু নিজের পদোন্নতি বা আর্থিক লাভের কথা ভাবেন, তাহলে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত উপকার হবে না। কিন্তু যদি তিনি শিক্ষকদের একটি দলের সঙ্গে কাজ করেন, যেখানে মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার মান উন্নয়ন, তখন পুরো প্রতিষ্ঠান উপকৃত হয়। ব্যক্তির সার্থকতা তখনই আসে যখন সে দলকে সাফল্যের পথে নিয়ে যেতে পারে।

ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এক ধরনের আত্মকেন্দ্রিকতা জন্ম দেয়, যা সমাজকে বিভক্ত করে। দলীয় চিন্তা একতা ও সহযোগিতার বীজ বপন করে। দলবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই গড়ে ওঠে সম্মিলিত উন্নয়ন।


দলের চেয়ে দেশ বড়—এর তাৎপর্য

যে কোনো দলের কার্যক্রম শেষ পর্যন্ত দেশের কল্যাণে নিবেদিত হওয়া উচিত। দল যদি নিজের স্বার্থকেই দেশের স্বার্থের চেয়ে বড় মনে করে, তাহলে তা সমাজে বিশৃঙ্খলা ডেকে আনে। আজকের বিশ্বে আমরা দেখি অনেক রাজনৈতিক দল, যারা নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে গিয়ে জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রবণতা।

একটি দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা সবই দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত। এসব ক্ষেত্রে কোনো দলীয় প্রভাব পড়লে তা দেশের অগ্রগতিকে ব্যাহত করে। তাই প্রত্যেক দলের উচিত—নিজেদের আদর্শ বা নীতি মেনে চললেও তা যেন দেশের বৃহত্তর স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়।


সমাজে এর প্রয়োগ

১. শিক্ষা খাতে: শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানকে ভালো রাখতে হলে একত্রে কাজ করতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সব শিক্ষকের ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে। একইভাবে, পুরো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সব প্রতিষ্ঠানকে মিলিতভাবে কাজ করতে হয়।

২. প্রশাসনে: প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত সুবিধার বদলে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতার ওপর জোর দিতে হয়। একজন ভালো কর্মকর্তা জানেন, তাঁর কাজ ব্যক্তিগত পদোন্নতি নয়, বরং প্রশাসনের কাঠামোকে দেশের জন্য কার্যকর রাখা।

৩. স্বাস্থ্যখাতে: চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য বিভাগের দলীয় কর্মকাণ্ডকে গুরুত্ব দিতে হয়, যার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য দেশবাসীর সেবা।

৪. রাজনীতিতে: রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ক্ষমতা রক্ষা কিংবা জয়-পরাজয়ের দিকেই বেশি মনোযোগ দিলে দেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু যদি তারা দেশের উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় একযোগে কাজ করে, তাহলে একটি কার্যকর রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।


ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত

১. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: ১৯৭১ সালে ব্যক্তি, দল, ধর্ম, মতবাদ সবকিছু ছাপিয়ে একটি আদর্শ সামনে এসেছিল—স্বাধীনতা। তখন দেশের স্বার্থই ছিল সবার চূড়ান্ত লক্ষ্য। মুক্তিযোদ্ধারা দলবদ্ধভাবে দেশের জন্য লড়াই করেছেন, ত্যাগ করেছেন নিজের জীবন। এটি একটি সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত।

২. ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন: মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু—যাঁরা নিজের স্বার্থ ভুলে দলীয়ভাবে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের লক্ষ্য ছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত ক্ষমতা বা স্বীকৃতি নয়।


আধুনিক প্রেক্ষাপটে এই নীতির প্রাসঙ্গিকতা

বর্তমান বিশ্বের নানা সংকট—পরিবেশ দূষণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন—সমাধানে ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে দলীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। এখানে যদি ব্যক্তি বা দল নিজেদের স্বার্থে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে বিশ্বমানবতার ক্ষতি হবেই।

আজকের তরুণদের এই মূল্যবোধ শেখানো জরুরি—তোমার চিন্তা শুধু তোমার ক্যারিয়ার নিয়ে নয়, বরং দলীয় উন্নয়ন এবং চূড়ান্তভাবে দেশের উন্নয়নের অংশ হওয়া উচিত।


এই নীতির অনুপস্থিতিতে বিপদ

যেখানে ব্যক্তিস্বার্থ বড় হয়ে ওঠে, সেখানে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দেয়। একটি উদাহরণ হলো প্রশাসনে দলীয়করণ। যখন কোনো দল দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ব্যবস্থায় নিজেদের স্বার্থ চাপিয়ে দেয়, তখন বিচারপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়, দেশ দুর্বল হয়।


আদর্শ সমাজ গঠনে এই নীতির বাস্তবায়ন

১. নৈতিক শিক্ষা: স্কুল ও কলেজে “দেশপ্রেম”, “দলীয় সংহতি”, “সামাজিক দায়বদ্ধতা”র ওপর পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

  1. গণমাধ্যমের দায়িত্ব: সংবাদমাধ্যম ব্যক্তিস্বার্থের প্রচার নয়, বরং দলীয় ও জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে।

  2. নীতিনির্ধারণে দলীয় দ্বন্দ্ব কমিয়ে আনা: সংসদীয় বা রাজনৈতিক আলোচনায় দলগুলো যেন জাতীয় স্বার্থকে সর্বাগ্রে রাখে।


উপসংহার

“ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়”—এই কথাটি শুধু একটি আদর্শ নয়, এটি একটি পথনির্দেশিকা। ব্যক্তি নিজের উন্নয়নকে দলের স্বার্থে উৎসর্গ করলে এবং দল দেশের উন্নয়নে নিবেদিত থাকলে সমাজে স্থিতিশীলতা, শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত হয়। এই নীতিকে শুধু মুখে নয়, কাজে রূপান্তর করতে হবে।

আমরা যদি নিজেদের সীমিত চাহিদার বাইরে গিয়ে দলীয় সহযোগিতার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করি, তাহলেই একটি উন্নত, ন্যায়ভিত্তিক, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। তাই আমাদের সবার মনে রাখতে হবে, আমি না, আমরা—এই চিন্তাই জাতি গঠনের প্রথম ধাপ।

No comments:

Post a Comment