Sunday, May 4, 2025

রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের কাজকে সীমাবদ্ধ করা কতটা যুক্তিসঙ্গত? – বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ

 



গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রশাসনিক কার্যকারিতা ও নীতিনির্ধারণে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার (autonomous bodies) ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদের কাজ হওয়া উচিত নিরপেক্ষ, দক্ষ এবং পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে। কিন্তু বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে একটি চলমান বিতর্ক রয়েছে: কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার অভিযোগ থাকলে তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া বা সীমাবদ্ধ করা উচিত কি না। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এ প্রশ্নের নৈতিকতা, যুক্তিকতা ও ভবিষ্যৎ প্রভাব বিশ্লেষণ করা হবে।


স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা কী এবং তাদের গুরুত্ব

স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো হলো এমন প্রতিষ্ঠান যা সরকারের অধীনে থাকলেও প্রশাসনিক ও আর্থিকভাবে কিছুটা স্বাধীনভাবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC), বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (BPSC), বাংলাদেশ ব্যাংক, তথ্য কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, ইত্যাদি।

এসব সংস্থা:

  • জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়ক হয়,

  • প্রশাসনিক ভারসাম্য রক্ষা করে,

  • জনগণের আস্থা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করে,

  • দক্ষ মানবসম্পদ উৎপাদনে ভূমিকা রাখে।


রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা: অর্থ ও বাস্তবতা

বাংলাদেশের রাজনীতি অনেকটাই আবেগতাড়িত, দলীয় বিভাজনে স্পষ্ট। দেশের প্রায় প্রতিটি স্তরে—চাকরি, শিক্ষা, এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা—রাজনৈতিক প্রভাব কোনো না কোনোভাবে বিদ্যমান। কেউ একটি রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস রাখতেই পারেন, যা তার সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সেটি যদি নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনে প্রভাব ফেলে, তখন প্রশ্ন ওঠে তার পেশাদারিত্ব নিয়ে।


সীমাবদ্ধতা আরোপ: যুক্তির পক্ষে বক্তব্য

১. পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত প্রতিরোধে

রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ব্যক্তিরা যদি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নেতৃত্বে থাকেন, তাহলে তাদের ব্যক্তিগত মতাদর্শ থেকে সরে এসে নিরপেক্ষ থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এতে সংস্থার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

২. জনআস্থার সংকট রোধে

যদি দেখা যায়, একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রকাশ্যে কোনো দলের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন, তাহলে সাধারণ মানুষ তার কর্মকাণ্ডের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দিহান হবে।

৩. দলীয়করণ প্রতিরোধে

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলবাজির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় বলয়ে পরিণত হচ্ছে। এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে ‘রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা’র ভিত্তিতে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ ন্যায্য বিবেচিত হতে পারে।


সীমাবদ্ধতা আরোপ: বিপক্ষে যুক্তি

১. মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সকল নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের অধিকার আছে। একজন নাগরিকের রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকা তার মৌলিক অধিকার—তাকে এই ভিত্তিতে চাকরি বা দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া অন্যায্য।

২. দক্ষতাকে অস্বীকার করা

একজন ব্যক্তি রাজনৈতিক চিন্তা রাখলেও তিনি যদি পেশাদার ও দক্ষ হন, তাহলে শুধুমাত্র তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের ক্ষতি ডেকে আনবে।

৩. ‘রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা’র সংজ্ঞা অস্পষ্ট

বাংলাদেশের মতো দেশে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার সংজ্ঞা প্রায়ই পক্ষপাতদুষ্ট হয়। কেউ কোনো সময় কোনো রাজনৈতিক সভায় উপস্থিত ছিলেন বা সামাজিক মাধ্যমে কোনো বক্তব্য দিয়েছেন, তাই তাকে "রাজনৈতিক" বলাটা একধরনের বিভ্রান্তিকর বিচার।

৪. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বৈত মানদণ্ড

অধিকাংশ সংসদ সদস্যই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। কিন্তু তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। অথচ স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার একজন কর্মকর্তা যদি রাজনৈতিক অবস্থান রাখেন, তাহলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটি এক ধরণের দ্বৈত নীতি।


বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতি

বাংলাদেশে প্রায়শ দেখা যায়, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি প্রকল্প বা নিয়ন্ত্রক সংস্থায় প্রধান পদগুলোতে দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এর ফলে:

  • প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে,

  • জনগণের আস্থা কমছে,

  • বিরোধী মতাবলম্বীদের মনে বৈষম্যের বোধ জন্ম নিচ্ছে।

তবে, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু পদক্ষেপ যেমন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়োগে বিজ্ঞতা ও ট্রান্সপারেন্সির দাবি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা একটি ইতিবাচক প্রবণতা।


প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারে?

১. নিরপেক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া:

  • PSC, UGC ইত্যাদি সংস্থাগুলো যেন স্বচ্ছ, মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করে।

২. নীতিগত কাঠামো শক্তিশালী করা:

  • রাজনৈতিক পক্ষপাতের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা।

৩. আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রয়োগ:

  • সরকারি কর্মকর্তারা কোনো দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না—এই নীতি কড়াভাবে বাস্তবায়ন।

৪. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা:

  • স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর কার্যক্রম নিয়মিতভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত।


সঠিক সমাধান কী হতে পারে?

সীমাবদ্ধতা আরোপ নয়, বরং নৈতিকতা, পেশাদারিত্ব এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা বেশি ফলপ্রসূ। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নয়, বরং কার্যক্রমে পক্ষপাত, দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতি থাকলে সেটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।


উপসংহার

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হলে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর কার্যক্রমকে নিরপেক্ষ, দক্ষ ও স্বচ্ছ রাখতে হবে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার অভিযোগে কারও দায়িত্ব সীমাবদ্ধ করা বা তাকে "নিম্নমানের" বলা যুক্তিযুক্ত নয়। এটি ব্যক্তির অধিকার হরণ, দক্ষতা অবমূল্যায়ন এবং প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করার নামান্তর।

প্রয়োজন হলো—নৈতিক আচরণ, পেশাগত মানদণ্ড, এবং সকল পক্ষের জন্য সমান নীতি। তাহলেই রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান দুটোই হবে শক্তিশালী ও আস্থাবান।

No comments:

Post a Comment