ভূমিকা
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটে করিডোরের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে নেপাল, ভুটান এবং চীনের সাথে স্থলপথে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের জন্য ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে করিডোর চেয়ে আসছে। তবে ভারত এ বিষয়ে বরাবরই অনীহা দেখিয়েছে, যদিও বাংলাদেশ তার বিপরীতে ভারতকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে যাতায়াতের জন্য ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, কেন ভারত বাংলাদেশকে সমপরিমাণ সুবিধা দিতে রাজি নয়?
ভৌগোলিক সংযোগ ও করিডোরের তাৎপর্য
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ভারত, নেপাল, ভুটান এবং মিয়ানমারকে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ করিডোর সরবরাহ করে আসছে। অপরদিকে, বাংলাদেশ যদি নেপাল, ভুটান ও চীনের সাথে সরাসরি স্থলপথে সংযুক্ত হয়, তবে এশিয়ার বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত ভারসাম্য নতুন মাত্রা পাবে।
আঞ্চলিক সংযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু তার অর্থনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করবে না, বরং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক প্রবাহকে আরও গতিশীল করে তুলতে পারবে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে (বিবিআইএন) মোটর ভেহিকল চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও ভারতের গড়িমসির কারণে এখনো তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
ভারতের দ্বৈত নীতি
ভারত বাংলাদেশকে মেঘালয়, আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গ হয়ে নেপাল ও ভুটানের সাথে করিডোর ব্যবহারের অনুমতি দিতে চায় না। অথচ ভারত নিজে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সহজে প্রবেশ করছে। এই দ্বৈত নীতির পেছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে:
১. কৌশলগত উদ্বেগ
ভারত মনে করে, চীনের সরাসরি উপস্থিতি তার ভূখণ্ডের খুব কাছাকাছি এলে নিরাপত্তা হুমকি তৈরি হতে পারে। চীন দীর্ঘদিন ধরে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন দেশকে পরিকাঠামোগত সুবিধা দিচ্ছে। বাংলাদেশ যদি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হয়, তবে চীনের প্রভাব এই অঞ্চলে আরও বাড়বে। ভারত এটাকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে।
২. অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা
বাংলাদেশের ভৌগোলিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে নেপাল ও ভুটান সরাসরি চীনের বাজারে প্রবেশ করতে পারলে ভারতীয় অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে। ভারত এই অঞ্চলকে তার অভ্যন্তরীণ বাজার হিসেবে দেখে এবং চায় না যে অন্য কোনো শক্তি এই সুবিধা নিক।
৩. ভূ-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ
ভারত নেপাল ও ভুটানকে তার বিশেষ প্রভাব বলয়ের মধ্যে রাখতে চায় এবং বাংলাদেশকে করিডোর দিলে এই দুই দেশ চীনের সাথে সহজেই সংযুক্ত হয়ে যেতে পারে। নেপাল ও ভুটান বর্তমানে ভারতীয় বন্দর ব্যবহারে বাধাগ্রস্ত হয়, যার ফলে তারা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বাংলাদেশ করিডোর দিলে তারা স্বাধীনভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করতে পারবে।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান
বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধি করতে চায়। নেপাল ও ভুটান ভারতীয় বন্দর ব্যবহারে অনেক সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়, অথচ তারা যদি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে, তবে তাদের আমদানি-রপ্তানি খরচ অনেক কমে যাবে।
বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে ভারতকে বোঝাতে পারে যে, পারস্পরিক সুবিধার ভিত্তিতে করিডোর ব্যবস্থা করলে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সংযোগ জোরদার হবে এবং সবাই উপকৃত হবে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে কূটনৈতিক নীতি অবলম্বন করছে। তবে এই নীতির সফলতার জন্য প্রয়োজন দক্ষ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।
করিডোর ইস্যুতে চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি
চীন বাংলাদেশকে তার বিআরআই প্রকল্পে আরও গভীরভাবে যুক্ত করতে চায়। চীন ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল এবং অন্যান্য বড় বড় প্রকল্প।
চীন যদি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি সংযোগ নিশ্চিত করতে পারে, তবে ভারতের ভূ-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে যাবে। এই কারণে ভারত বাংলাদেশকে করিডোর দিতে ভয় পায়।
ভবিষ্যত সম্ভাবনা
বাংলাদেশ কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে ভারতের উদ্বেগ নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, করিডোর ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা প্রদান, বাণিজ্যের স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং যৌথ বিনিয়োগ পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।
কিছু সম্ভাব্য পদক্ষেপ:
দ্বিপাক্ষিক সংলাপ জোরদার করা: বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভুটান একত্রে বসে করিডোর বাস্তবায়নের উপায় বের করতে পারে।
নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া: ভারত যাতে আশ্বস্ত হয় যে করিডোর ব্যবহার কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে না।
বাণিজ্য সম্প্রসারণ: ভারত যদি করিডোর দেয়, তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা দেওয়া যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক চাপে ভারতকে আনা: দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোকে যুক্ত করে ভারতকে করিডোর দিতে বাধ্য করা যেতে পারে।
উপসংহার
ভারতের উচিত বাংলাদেশকে তার ভূ-অর্থনৈতিক সুযোগকে কাজে লাগানোর সুযোগ দেওয়া। এটি শুধু বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান এবং চীনকেই নয়, বরং ভারতকেও উপকৃত করবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে ভারতের উচিৎ করিডোর ইস্যুতে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো, যাতে দক্ষিণ এশিয়া সত্যিকারের সংযুক্ত অঞ্চলে পরিণত হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে ভূরাজনৈতিক বাধাগুলো অতিক্রম করতে হবে। ভারত যদি সত্যিই আঞ্চলিক সংযোগ উন্নত করতে চায়, তবে তাকে তার নীতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশও তার কূটনৈতিক কৌশল আরও শক্তিশালী করে ভারতের সাথে সমান সুবিধার ভিত্তিতে আলোচনায় বসতে পারে।

No comments:
Post a Comment