Sunday, March 2, 2025

আমার দেখা শেষ বুলেট , লেখক: অজ্ঞাত এক সৈনিক

 



 জন্ম এক প্রতিজ্ঞার

১৯৯৬ সালের এক ভোরে আমার জন্ম, এক পাহাড়ি গ্রামে। চারদিকে সবুজের সমারোহ, মেঘ ছুঁয়ে যাওয়া পাহাড়ের মাথা, ঝিরঝিরে হাওয়ার সাথে মিশে থাকা নাম না জানা পাখির ডাক। আমার বাবা ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, মায়ের গলায় এখনো সেই সব দিনের গল্প ঝুলে থাকে হারিয়ে যাওয়া সোনালী চাবির মত। জন্মের পর থেকেই শুনেছি, বাবা বলতেন — "আমার ছেলে হবে সৈনিক, এই মাটির জন্য লড়বে!"

শৈশবটা কেটেছে গল্প শুনে — যুদ্ধের গল্প, দেশের গল্প, আর হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের গল্প। বাবা প্রায়ই বলতেন,
— "তোর দেখা হবে না, কিন্তু একদিন তুই এমন এক সময়ের মুখোমুখি হবি, যখন মনে হবে তোর হাতে থাকা শেষ বুলেটটাই সবচেয়ে দামি!"
আমি তখন বুঝতাম না, শেষ বুলেটের মানে কী।


২০২৫ সালের জানুয়ারি। চারদিকে হঠাৎ থমথমে এক পরিবেশ। দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অস্থিরতা। রাজনীতি, বিদ্রোহ, আর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে আমাদের চারপাশে যেন অদৃশ্য একটা আগুন জ্বলছে। আমি তখন সেনাবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট। আমাদের এক বিশেষ অপারেশনের জন্য ডাকা হলো — গোপন বিদ্রোহ দমনের মিশন, যেখানে শত্রুরা এতটাই শক্তিশালী যে, আমাদের এক মুহূর্তের ভুল মানেই মৃত্যু।

আমার রাইফেল, আমার হেলমেট, আর আমার ইউনিফর্ম — এগুলো যেন আমার আত্মার অংশ হয়ে গেছে। দেশের জন্য লড়তে হবে — বাবার স্বপ্ন আর আমার শপথ এক হয়ে মিশে গেছে।


জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে আমাদের পাঠানো হলো এক গোপন মিশনে। পাহাড়ি এলাকায় লুকিয়ে থাকা শত্রু ক্যাম্প ধ্বংস করা আমাদের কাজ। আমাদের সঙ্গে ছিল ১২ জনের একটি দল। আমরা সবাই জানতাম, ফিরে আসা হবে না, কিন্তু দেশের জন্য মরতে কারো দ্বিধা ছিল না।
পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে আমি অনুভব করলাম, এই মাটি, এই গন্ধ — সবই আমার পরিচিত। যেন এই মাটির নিচেই লুকিয়ে আছে আমার বাবার বীরত্বের গল্প।

এক রাতে ক্যাম্পে বসে, আমি আমার ডায়েরিতে লিখলাম:
"যদি এই পাহাড়ের কোলে মৃত্যুও আসে, আমি হাসিমুখে বরণ করবো। এক হাতে থাকবে রাইফেল, আরেক হাতে শেষ বুলেট।"


জুলাইয়ের ১৩ তারিখ। ভোরের প্রথম আলোয় শত্রু ক্যাম্পের খুব কাছে পৌঁছলাম। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা কুয়াশা আমাদের ঢেকে রাখছিল। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো একটা গুলির শব্দ। আমাদের দলের কর্পোরাল আজাদ পড়ে গেলেন। আমি চোখের সামনে দেখলাম, তার বুক চিরে রক্তের ধারা নামছে।
আমি রাইফেল হাতে নিয়ে পাল্টা গুলি ছুঁড়লাম, পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শত্রুর মাথা ফাটিয়ে দিলাম। আজাদের নিথর দেহ দেখে আমি মনে মনে শপথ করলাম — শেষ পর্যন্ত লড়বো।


রাতে যখন সব নিস্তব্ধ, তখন আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম — এই রাত কতগুলো মানুষের নিঃশ্বাস নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের খাবার শেষের পথে, পানির বোতলগুলো প্রায় খালি, কিন্তু চোখের ভেতর আগুন জ্বলছে।
আমার এক হাতে রাইফেল, অন্য হাতে বাবার দেওয়া পুরনো চাবির রিং — যার গায়ে খোদাই করা ছিল "মুক্তি" শব্দটা।

সে রাতে দলের সবাই একসাথে বসেছিলাম। কেউ কেউ নিজেদের শেষ চিঠি লিখছিল, কেউ আবার চোখ বন্ধ করে নিজের বাড়ির কথা ভাবছিল। আমি শুধু ভাবছিলাম শেষ বুলেটটার কথা — সেই বুলেট যেটা হয়তো আমার হবে, অথবা শত্রুর বুক চিরে যাবে।


জুলাইয়ের ১৯ তারিখ। আমাদের দল থেকে হারিয়ে গেল দুইজন — সৈনিক নাসির আর ক্যাপ্টেন তন্ময়। প্রথমে ভাবলাম, শত্রুর হাতে পড়েছে, পরে বুঝলাম — তারা নিজেরাই আমাদের অবস্থান ফাঁস করে পালিয়েছে।
বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষত সবচেয়ে বড়। দলের ভেতর অবিশ্বাসের বিষ ঢুকে গেল। কে বন্ধু, কে শত্রু — আলাদা করা কঠিন হয়ে গেল।


জুলাইয়ের ২৫ তারিখ। আমাদের চারপাশে শত্রুর ঘেরাও, খাবার নেই, গোলাবারুদ শেষ প্রায়। আমার রাইফেলে মাত্র একটা বুলেট। সবাই বলল, আত্মসমর্পণ করো। কিন্তু আমি জানি, বাবার সেই কথা — "শেষ বুলেট কখনো আত্মসমর্পণের জন্য নয়, সেটা সম্মানের জন্য।"
আমি চোখ বন্ধ করলাম। মনে মনে বাবাকে বললাম,
— "দেখো বাবা, তোমার ছেলে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবে।"


জুলাইয়ের ২৬ তারিখ রাত। শত্রুরা যখন আমাদের ঘিরে ফেলেছে, তখনই আমার রাইফেলের সেই শেষ বুলেটটাকে আমি ভালো করে দেখলাম।
রক্তে ভেজা হাত, বুকের ভেতর দমবন্ধ করা ভয় — সব ছাপিয়ে উঠল একটা অনুভূতি।
আমি সেই শেষ বুলেটটা তুলে নিয়ে, রাইফেলের চেম্বারে ভরলাম। সামনে দাঁড়ানো শত্রুর কমান্ডারের চোখে চোখ রাখলাম।
তার চোখে ছিল তৃপ্তির হাসি — যেন সে জানে, আমাদের পরাজয় অনিবার্য।
আমি হাসলাম।
ঠান্ডা মাথায় ট্রিগার টানলাম।
শেষ বুলেটটা ছুটে গিয়ে তার কপালে বিধলো।

আমি পড়ে গেলাম। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল আমার শরীর। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মনে হলো — আমি জিতে গেছি।
আমার দেখা শেষ বুলেট আমার দেশের জন্যই ছুটেছিল।


এই গল্প কেউ জানে না। এই গল্প শুধু জানে আমার রাইফেল, আমার মাটি, আর সেই শেষ বুলেট — যে বুলেট দেশপ্রেমের সাক্ষী হয়ে আছে এক পাহাড়ি ঝর্ণার পাশে।
কয়েক বছর পর এক শিশুর হাতে উঠবে সেই রাইফেল, সেই গল্প সে বলবে অন্যদের — এক সৈনিকের শেষ বুলেটের গল্প।


"শেষ বুলেট কখনো ভয় পায় না, কারণ সে জানে তার শেষ যাত্রা হবে দেশের জন্য।"

No comments:

Post a Comment