বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে থাকা দেশ, যেটি বিশ্বের বৃহৎ অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তিগুলোর প্রভাবের আওতায় পড়ে। দেশটির অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সামরিক কৌশল আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং বহুমুখী আন্তর্জাতিক কূটনীতি বাংলাদেশের উন্নয়ন, বাণিজ্য, মানবাধিকার, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির ওপর কীভাবে বৈশ্বিক ঘটনাগুলো প্রভাব ফেলে, তা বোঝার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকট ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর নৃশংস অভিযান চালানোর পর প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। এই সংকট বাংলাদেশের জন্য একটি বড় মানবিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভূমিকাই সংকটের সমাধানে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
মহাশক্তিগুলোর অবস্থান
চীন ও রাশিয়া: জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে চীন ও রাশিয়া বাধা প্রদান করে। তারা মিয়ানমারের প্রতি তাদের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন: রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা জানায় এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে, তারা বাংলাদেশকে সরাসরি তেমন কোনো আর্থিক সহযোগিতা দেয়নি।
ভারত: মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষার জন্য দ্বৈত নীতি গ্রহণ করেছে। একদিকে বাংলাদেশকে মানবিক সহায়তা প্রদান করেছে, অন্যদিকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়নি।
এতে বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে বাংলাদেশ প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাচ্ছে না, যা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে বড় বাধা।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক কৌশল
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
নিষেধাজ্ঞার কারণ ও প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের মতে, র্যাব বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী।
এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সম্পর্ক কিছুটা দুর্বল হয়।
বাংলাদেশ পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন হারানোর আশঙ্কায় পড়ে।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টা চালায়।
ভারত ও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যায়, যাতে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা যায়।
এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা, যেখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতির শক্তিশালী প্রভাব দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়েও পরিবর্তন আনতে পারে।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) ও বাংলাদেশের ভূ-অর্থনীতি
চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' (BRI) বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। তবে এটি কেবল অর্থনৈতিক প্রকল্প নয়, বরং এর ভেতরে রয়েছে গভীর ভূ-রাজনৈতিক কৌশল।
BRI-এর ইতিবাচক দিক
বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ নিয়ে অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
রেল, সড়ক ও সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন হচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।
BRI-এর চ্যালেঞ্জ ও রাজনৈতিক উদ্বেগ
চীনের ঋণ বাংলাদেশকে 'ঋণের ফাঁদে' ফেলতে পারে বলে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করেছে।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সতর্ক করে দিয়েছে, যাতে চীনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল না হয়।
বাংলাদেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব
২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও খাদ্যের দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি সরাসরি প্রভাবিত হয়।
অর্থনৈতিক প্রভাব
তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দেয়।
খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়ে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রায় চাপ সৃষ্টি হয়।
ডলারের সংকট তৈরি হয়, যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্রাস পায়।
রাজনৈতিক প্রভাব
রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিন্দা প্রস্তাবে বাংলাদেশ অংশ নেয়নি, যা দেশটির কৌশলগত নিরপেক্ষ অবস্থান নির্দেশ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কিছুটা জটিল হয়।
বাংলাদেশ বিকল্প বাজার খুঁজতে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে বাধ্য হয়।
বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান
বাংলাদেশ বর্তমানে একটি নীতিগত ভারসাম্য বজায় রেখে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। এতে কয়েকটি দিক গুরুত্বপূর্ণ:
কূটনৈতিক ভারসাম্য: চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলার নীতি গ্রহণ।
অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণ: চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর চেষ্টা।
মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ইমেজ উন্নয়ন: আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্য প্রশাসনিক সংস্কার গ্রহণ।
উপসংহার
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই দেশটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থাকতে পারে না। তবে কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা ও ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারে।
বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে আরও দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতাকে বুঝে উন্নয়নের পথ অনুসরণ করতে হবে।

No comments:
Post a Comment