BUY NOW
শৈশবের দিনগুলো ছিল নিঃসন্দেহে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। চারপাশে দুশ্চিন্তা ছিল না, ছিল শুধু নির্ভেজাল আনন্দ, দুঃসাহসিক কল্পনা আর অকৃত্রিম বন্ধুত্ব। তখনকার সময় আমাদের কাছে ছোট ছোট ঘটনাগুলো ছিল মহাকাব্যের মতো, যেখানে আমরা নিজেদের নায়ক ভাবতাম। আজও আমি আমার হৃদয়ে এমন একটি স্মৃতি লালন করি, যা বন্ধুত্ব, ভালোবাসা এবং সাহসিকতার এক অনন্য নিদর্শন হয়ে আছে।
আমার শৈশব কেটেছে ছোট্ট এক শহরে, যেখানে খেলার মাঠ আর অজানা অভিযানের জায়গা কম ছিল না। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল রিফাত। আমরা দুজন সবসময় একসঙ্গে থাকতাম—স্কুলে, মাঠে, কিংবা কোনো নতুন দুঃসাহসিক পরিকল্পনায়। আমাদের মধ্যে একটা অলিখিত নিয়ম ছিল—যেখানেই যাই, একসঙ্গে যাব, আর যেকোনো সমস্যার সমাধান একসঙ্গেই করব।
দুঃসাহসিক অভিযানের শুরু
একদিন বিকেলে আমরা ঠিক করলাম, শহরের পাশের ছোট বনটায়探险 (অন্বেষণ) করব। ছোটবেলায় এই বনটাকে আমাদের কাছে রহস্যময় এক জায়গা মনে হতো। সেখানে নাকি একটা পুরোনো ধ্বংসস্তূপ ছিল, যেখানে বহু বছর আগে কেউ থাকত। লোকজন বলত, সেখানে এখনো লুকিয়ে আছে অদৃশ্য কিছু, যা রাতের আঁধারে ঘোরাফেরা করে। আমাদের কিশোর মনে এসব কথা আরো আগ্রহ বাড়িয়ে তুলেছিল।
রিফাত বলল, "চল, আজ সন্ধ্যার আগে ধ্বংসস্তূপটা দেখে আসি।"
আমি একটু দ্বিধাগ্রস্ত হলেও ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত ছিলাম। ব্যাগে বিস্কুট, পানি আর একটা ছোট টর্চলাইট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা জানতাম, সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসতে হবে, নাহলে বাড়িতে ঝড় উঠবে।
বনের ভেতরে ঢুকতেই আশেপাশের পরিবেশ বদলে গেল। পাখির ডাক, পাতার মর্মর ধ্বনি আর অদ্ভুত এক গন্ধ আমাদের ঘিরে ফেলল। যতই এগিয়ে যাচ্ছিলাম, ততই মনে হচ্ছিল, যেন অন্য এক জগতে চলে এসেছি। চারপাশের গাছগুলো ঘন হয়ে আসছিল, সূর্যের আলো ধীরে ধীরে ফিল্টারের মতো পাতার ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করছিল।
আমরা প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর একটা ছোট পুলের কাছে এসে থামলাম। হঠাৎই দূর থেকে এক অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পেলাম—মিয়াও মিয়াও!
সাহসিকতার আসল পরীক্ষা
আমি আর রিফাত কিছুক্ষণ চারপাশ দেখলাম। পুলের পাশেই একটা ছোট বিড়ালছানা পানিতে পড়ে গেছে আর বাঁচার জন্য ছটফট করছে। আমাদের মনটা একদম কেঁপে উঠল। পানিটা খুব গভীর ছিল না, তবে বিড়ালছানাটার পক্ষে নিজে থেকে বের হওয়া অসম্ভব ছিল।
আমি বললাম, "কী করি? দড়ি থাকলে হয়তো তুলতে পারতাম!"
রিফাত বলল, "দাঁড়া, আমি নামছি!"
আমি হতবাক হয়ে গেলাম। "তুই কি পাগল? যদি পড়ে যাস?"
কিন্তু রিফাত কোনো কথা না শুনেই জুতো খুলে পানিতে নেমে পড়ল। ওর মুখে ছিল একরকম দৃঢ়তা। ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে ও বিড়ালছানার কাছে পৌঁছাল। আমি তখনও অস্থির হয়ে চারপাশ দেখছিলাম, যদি কোনো কিছু দিয়ে সাহায্য করা যায়।
পানি ঠান্ডা ছিল, আর জায়গাটা একটু পিচ্ছিল। কিন্তু রিফাত কষ্ট করে বিড়ালছানাটাকে হাতে তুলে নিল। তারপর ধীরে ধীরে পানির বাইরে আসতে লাগল। ওর পুরো শরীর ভিজে গিয়েছিল, কিন্তু মুখে ছিল বিজয়ের হাসি।
আমরা বিড়ালছানাটাকে শুকনো কাপড়ে মুছে এক জায়গায় বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। ওর গা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল, তাই আমরা ওকে আমাদের গায়ের গরম দিয়ে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিছুক্ষণ পর ও একটু স্বাভাবিক হলো, আর ছোট ছোট মিউ মিউ শব্দ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকল।
বন্ধুত্বের গভীরতা
আমরা বিড়ালছানাটাকে ফেলে যেতে পারছিলাম না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, সেটাকে নিয়ে যাব। কিন্তু কোথায় দেব? আমাদের বাড়িতে তো রাখা সম্ভব না।
ঠিক তখনই মনে পড়ল, পাশের একটা বাড়িতে এক দয়ালু আন্টি থাকেন, যিনি অনেক পশু পাখির যত্ন নেন। আমরা ওনার বাড়িতে গিয়ে দরজায় নক করলাম। উনি দরজা খুলেই বিস্মিত হয়ে বললেন, "এত ভেজা অবস্থায় তোমরা কী করছো?"
আমরা পুরো ঘটনাটা বললাম। আন্টি হাসলেন, তারপর বিড়ালছানাটাকে কোলে নিয়ে আদর করলেন। উনি বললেন, "এটা সত্যিই খুব ভালো কাজ করেছো। অনেকেই হয়তো দেখে চলে যেত, কিন্তু তোমরা ওকে বাঁচানোর জন্য এত পরিশ্রম করেছো।"
আমাদের বুকটা গর্বে ভরে গেল। সেদিন বুঝলাম, সাহসিকতা মানে শুধু বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়া নয়, বরং অন্যের জন্য কিছু করা, নির্ভয়ে সাহায্যের হাত বাড়ানোই সত্যিকারের সাহস।
এক আজীবন মনে রাখার শিক্ষা
সেই দিনের সেই মুহূর্তটা আজও আমার মনে গেঁথে আছে। রিফাতের সাহস, আমাদের বন্ধুত্ব, আর এক নিষ্পাপ প্রাণকে বাঁচানোর আনন্দ—সব মিলিয়ে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। সেদিন আমি শিখেছিলাম, সত্যিকারের বন্ধুত্ব শুধু হাসি-আনন্দ ভাগাভাগির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিপদের মুহূর্তে পাশে দাঁড়ানোর মধ্যেই তার আসল সৌন্দর্য।
অনেক বছর কেটে গেছে, আমরা বড় হয়েছি, জীবন বদলে গেছে। রিফাত এখন অন্য শহরে থাকে, আমিও পড়াশোনা আর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু যখনই ছোটবেলার দিনগুলোর কথা ভাবি, সেই বিশেষ ঘটনাটি মনে পড়ে যায়। আমি মনে করি, সেই ছোট্ট অভিযানের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল বন্ধুত্বের আসল মানে—একজন আরেকজনের জন্য নির্ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া, একসঙ্গে কঠিন সময় পার করা, আর একে অপরের পাশে থাকা।
আমাদের সেই উদ্ধার করা বিড়ালছানাটাও হয়তো বড় হয়ে গেছে। হয়তো সে এখন সুখে আছে, হয়তো সে জানে না কারা একদিন তাকে বাঁচিয়েছিল। কিন্তু আমরা জানি, সেদিন আমরা শুধু একটি প্রাণীকে বাঁচাইনি, বরং আমরা নিজেদের শৈশবের এক উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছিলাম, যা আমাদের বন্ধুত্বকে আরও শক্তিশালী করেছিল।
বন্ধুত্ব মানে শুধু একসঙ্গে খেলা করা নয়, বন্ধুত্ব মানে হলো একে অপরের জন্য সাহস দেখানো, পরস্পরের জন্য দাঁড়ানো। আর সেটাই আমাদের শৈশবের সবচেয়ে মূল্যবান শিক্ষা।









